আন্দোলন: ফ্যাসিবাদের পতন ও বাংলাদেশের নতুন স্বাধীনতার সূচনা

২০২৪ সালের  ছাত্রআন্দোলন: ফ্যাসিবাদের পতন ও বাংলাদেশের নতুন স্বাধীনতার সূচনা

ভূমিকা

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের একটি গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন — সব ক্ষেত্রেই ছাত্র সমাজ ছিল অগ্রভাগে। ঠিক তেমনই, ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন ছিল এক অনন্য মাইলফলক, যেখানে ছাত্রসমাজ তাদের রক্ত, ঘাম ও সাহসিকতার মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোড়ন তোলে। এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের অবসান ঘটানো এবং জনগণের জন্য সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে তোলা।


শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসন ও ফ্যাসিবাদের সূচনা

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় একের পর এক রাজনৈতিক নাটকীয়তা। প্রথমদিকে উন্নয়নের অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে শেখ হাসিনার সরকার ক্রমাগতভাবে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে লিপ্ত হয়। বিরোধীদল দমন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার, গুম-খুনের রাজনীতি—এসবই দেশের সাধারণ জনগণের নিত্যদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়।

বিশেষ করে ২০১৮ সালের একতরফা সংসদ নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন এবং বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তা দেশের জনগণ বিশেষ করে তরুণ সমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ভুয়া ভোট, প্রশাসনের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব, বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, পুলিশি হয়রানি—এসবের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে জমে ওঠে প্রতিবাদ। কিন্তু ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন ছিল এই ক্ষোভের সবচেয়ে শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ।

২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত

২০২৪ সালের শুরু থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল চরমে। শিক্ষা খাতে দুর্নীতি, চাকরির বাজারে বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এবং সর্বোপরি সরকার কর্তৃক শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার হরণ—এসব কারণে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্রসমাজ।
বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পুনরুত্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের বিরুদ্ধে আওয়াজ, এবং সর্বশেষে নিরাপদ ক্যাম্পাস ও ন্যায়বিচারের দাবিতে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার ছাত্র।

এই আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান ছিল:
“স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমরা পরাধীন কেন?”
“ফ্যাসিবাদের পতন চাই, গণতন্ত্র ফেরত চাই!”

ছাত্রদের এই আন্দোলন ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়।

পুলিশের দমন-পীড়ন ও আন্দোলনের তীব্রতা

শুরু থেকেই সরকার এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য পুলিশ, র‍্যাব, ছাত্রলীগসহ সরকারি বাহিনীকে ব্যবহার করে। আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুম, গ্রেপ্তার, হামলা, এমনকি গুলি চালানোর মতো জঘন্য দমননীতি শুরু হয়।
স্মরণীয় হয়ে আছে ধানমণ্ডি, শাহবাগ, রাজশাহী চারুকলা মোড়, খুলনা নিউ মার্কেট, চট্টগ্রাম জিইসি মোড়ে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্রদের দৃশ্য।
এই সকল শহীদের রক্ত ছাত্র আন্দোলনকে আরও বিস্ফোরক করে তোলে। জনতার মধ্যে জন্ম নেয় নতুন প্রত্যাশা, নতুন স্বপ্ন—একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও সত্যিকার স্বাধীন দেশ গড়ে তোলার।

শেখ হাসিনার পতনের

শেখ হাসিনার পতনের নেপথ্য বাস্তবত ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ জনগণও রাস্তায় নামতে শুরু করে। শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, আইনজীবী, সুশীল সমাজ—সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়। শেখ হাসিনার সরকার একদিকে প্রশাসনিক দমননীতি, অন্যদিকে গোপনে সমঝোতার পথ খোঁজে। কিন্তু ছাত্রদের দৃঢ় অবস্থান, জনগণের ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক চাপের ফলে সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

অবশেষে ২০২৪ সালের শেষভাগে শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হন। দেশের ইতিহাসে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন, যেখানে ছাত্র আন্দোলন সরাসরি একটি ফ্যাসিস্ট শাসকের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

নতুন স্বাধীনতার ধারণা: ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্ন


শেখ হাসিনার পতনের পর ছাত্র সমাজ ও জনগণের মধ্যে যে নতুন চিন্তা-ভাবনার জন্ম হয়, সেটিই “নতুন স্বাধীনতা” বা “দ্বিতীয় মুক্তি সংগ্রাম” হিসেবে পরিচিতি পায়। এ স্বাধীনতা শুধু ভৌগোলিক নয়, এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রতীক।

নতুন স্বাধীনতার মূলনীতি:

১. সুশাসন ও জবাবদিহিতা: সরকারি প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।

২. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের কার্যকর ভূমিকা।
৩. মানবাধিকার রক্ষা: গুম-খুন, মিথ্যা মামলা, দমন-পীড়নের অবসান।
৪. শিক্ষার সংস্কার: দলীয়করণমুক্ত, মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা।
৫. বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান: টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা।
৬. সাংবাদিকতার স্বাধীনতা: ভয়ের বাইরে সত্য প্রকাশের অধিকার।
৭. সামাজিক সাম্য: ধনী-দরিদ্র বৈষম্য হ্রাস এবং নারী-পুরুষ সমতা।

ছাত্রদের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

এই নতুন স্বাধীনতার বাস্তবায়নে ছাত্র সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র শাসক পতন করলেই পরিবর্তন আসে না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাষ্ট্রের কাঠামো এবং জনগণের মননে পরিবর্তন আনা জরুরি।

তবে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জও কম নয়।

  • পুরনো শাসকের অনুসারীরা সক্রিয় রয়েছে।

  • আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র আছে।

  • অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা কঠিন।

তাই ছাত্র সমাজকে শুধু প্রতিবাদেই থেমে না থেকে, সংগঠিত, শিক্ষিত, সচেতন এবং নেতৃত্বদানের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। রাজনৈতিক সুশৃঙ্খলা, আদর্শিক দৃঢ়তা এবং জনগণের সঙ্গে একাত্মতা বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে।

শেষ কথা

৫ আগস্ট সরকারের পলায়নের মাধ্যমে দেশে নতুন স্বাধীনতার জন্ম হয়। এদেশের মানুষ নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখে,। অত্যাচারিত নিপীড়িত দুর্ধর্ষ সরকার দুঃশাসন থেকে জনগণ মুক্তি লাভ করে ।দেশের জনগণ ভবিষ্যতে আর কখনো এরকম সরকার দেখতে চায় না।

২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মাধ্যমে যে নতুন স্বাধীনতার স্বপ্ন জাতি দেখছে, তা বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।  এই আন্দোলন শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
একটি শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এর অগ্রভাগে আছে আমাদের ছাত্রসমাজ। তাদের হাত ধরেই রচিত হবে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
1 জন কমেন্ট করেছেন ইতোমধ্যে
  • shiddik
    shiddik July 6, 2025 at 4:19 PM

    https://www.basicinfoit.com

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url