হাঁটু ব্যথা: কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার, ব্যায়াম,
হাঁটু ব্যথা: কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার, ব্যায়াম, ঔষধ ও ডাক্তারের পরামর্শসহ বিস্তারিত আলোচনা
ভূমিকা
হাঁটু মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ যা আমাদের দৈনন্দিন চলাফেরার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বয়স বৃদ্ধি, আঘাত, অতিরিক্ত ওজন, বা কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণে হাঁটুতে ব্যথা দেখা দিতে পারে। এই ব্যথা কখনও কখনও এতটাই তীব্র হয় যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই হাঁটু ব্যথার কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার এবং চিকিৎসা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি।
হাঁটু ব্যথার কারণসমূহ
হাঁটু ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। নিচে এর প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো:
১. আর্থ্রাইটিস (Arthritis)
-
অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis): বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুর জয়েন্টের কার্টিলেজ ক্ষয় হয়ে গিয়ে হাড়ে হাড় ঘষা খেতে থাকে, যার ফলে ব্যথা হয়।
-
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis): এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যা হাঁটুর অভ্যন্তরীণ গঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
২. হাড়ে বা জয়েন্টে আঘাত
হাঁটুতে আঘাত লাগলে মাংসপেশি, লিগামেন্ট, বা মিনিসকাস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে তীব্র ব্যথা ও ফুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।
৩. অতিরিক্ত ওজন
অতিরিক্ত ওজন হাঁটুর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে হাঁটু দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ও ব্যথা শুরু হয়।
৪. হঠাৎ অতিরিক্ত পরিশ্রম
খেলা, ব্যায়াম বা ভারী কাজ করার সময় হঠাৎ বেশি হাঁটাচলা করলে হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে।
৫. গাউট (Gout)
রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে তা হাঁটুর জয়েন্টে জমা হয় এবং তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে।
৬. বার্সাইটিস (Bursitis)
হাঁটুর পাশে থাকা তরলভর্তি থলির প্রদাহ হলে হাঁটু ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়।
হাঁটু ব্যথার লক্ষণ
হাঁটু ব্যথা সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট উপসর্গের মাধ্যমে ধরা পড়ে। নিচে লক্ষণগুলো উল্লেখ করা হলো:
-
হাঁটুর জয়েন্টে তীব্র বা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা ব্যথা
-
হাঁটু ফুলে যাওয়া বা লাল হয়ে যাওয়া
-
হাঁটুতে শক্ত হয়ে যাওয়া বা বেঁকে না যাওয়া
-
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে বা নামতে কষ্ট হওয়া
-
হাঁটার সময় ‘ক্লিক’ বা কড়কড় শব্দ হওয়া
-
ব্যথা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুতে দুর্বলতা অনুভব হওয়া
-
দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর হাঁটু শক্ত হয়ে যাওয়া
হাঁটু ব্যথা থেকে প্রতিকার
১. বিশ্রাম (Rest)
হাঁটুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিলে ব্যথা অনেকাংশে হ্রাস পায়। অতিরিক্ত চলাফেরা থেকে বিরত থাকা উচিত।
২. বরফ লাগানো (Ice Therapy)
দিনে ২–৩ বার ১৫–২০ মিনিট হাঁটুতে বরফ লাগালে ব্যথা ও ফোলা কমে যায়।
৩. হাঁটু উঁচু করে রাখা (Elevation)
হাঁটুকে বালিশ বা কুশনের উপর তুলে রাখলে রক্ত চলাচল ঠিক থাকে ও ফোলা কমে যায়।
৪. হালকা ম্যাসাজ
হালকা হাতে তেল বা জেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে আরাম পাওয়া যায়।
৫. ওজন নিয়ন্ত্রণ
যাদের ওজন বেশি, তাদের দ্রুত ওজন কমানো প্রয়োজন। এতে হাঁটুর ওপর চাপ কমে ও ব্যথা কমে যায়।
হাঁটু ব্যথার জন্য করণীয় ব্যায়াম
সঠিক ব্যায়াম করলে হাঁটুর শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়। নিচে কিছু কার্যকরী ব্যায়াম দেওয়া হলো:
১. কুয়াড্রিসেপ স্ট্রেংথেনিং
-
চেয়ারে বসে হাঁটু সোজা করে সামনের দিকে টান দিন।
-
প্রতিটি পা দিয়ে ১০ বার করুন।
২. হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ
-
পা সোজা করে বসে পায়ের আঙুল স্পর্শ করার চেষ্টা করুন।
-
১৫–২০ সেকেন্ড ধরে রাখুন।
৩. লেগ রেইজ
-
শুয়ে থেকে এক পা ৪৫ ডিগ্রি কোণে তুলে রাখুন।
-
ধীরে ধীরে নামিয়ে ফেলুন।
-
প্রতিটি পায়ে ১০ বার।
৪. সিট টু স্ট্যান্ড
-
চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে দাঁড়ান ও আবার বসুন।
-
হাঁটুর পেশি শক্তিশালী হয়।
সতর্কতা: ব্যথা বেশি থাকলে বা হাঁটু ফুলে থাকলে ব্যায়াম না করাই ভালো। ডাক্তার বা ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিন।
হাঁটু ব্যথার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধ
হাঁটু ব্যথা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে:
১. পেইনকিলার (Painkillers)
-
প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন
-
অস্থায়ীভাবে ব্যথা কমায়
২. অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ঔষধ (NSAIDs)
-
ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক
-
ফোলা ও প্রদাহ কমায়
৩. গ্লুকোজামিন ও কনড্রইটিন
-
জয়েন্টের ক্ষয় কমাতে সাহায্য করে
-
দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর
৪. টপিক্যাল জেল
-
ভোল্টারেন, ফ্লেমেক্স জাতীয় জেল ব্যথা উপশমে ভালো কাজ করে
৫. ইনজেকশন
-
কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন হাঁটুর মধ্যে প্রয়োগ করলে তীব্র ব্যথা ও ফোলাভাব কমে।
ডাক্তারের পরামর্শ কখন নেওয়া উচিত?
নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
-
ব্যথা এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে
-
হাঁটুতে তীব্র ফোলা বা লালচে ভাব দেখা দিলে
-
হঠাৎ করে হাঁটু বেঁকে গেলে বা লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে
-
জ্বর, গাঁটে ফোলা এবং গাউটের উপসর্গ দেখা দিলে
-
হাঁটুর নড়াচড়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেলে
চিকিৎসক প্রয়োজনে নিচের টেস্ট বা পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন:
-
এক্স-রে
-
এমআরআই (MRI)
-
ব্লাড টেস্ট
-
আরথ্রোস্কপি (হাঁটুর অভ্যন্তর পরিদর্শন)
হাঁটু ব্যথা প্রতিরোধে করণীয়
-
নিয়মিত হালকা হাঁটাহাঁটি করুন
-
মোটা জুতো বা শক অ্যাবজর্বিং সোল ব্যবহার করুন
-
সিঁড়ি উঠানামায় সাবধান থাকুন
-
দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা এড়িয়ে চলুন
-
পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার গ্রহণ করুন
প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও ঘরোয়া উপায়
১. আদা ও হলুদের চা
প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি হিসেবে কাজ করে।
২. রসুন
দৈনিক সকালে ২–৩ কোয়া কাঁচা রসুন খেলে হাঁটুর ব্যথা কিছুটা উপশম হয়।
৩. তিলের তেল
গরম করে হালকা ম্যাসাজ করলে আরাম পাওয়া যায়।
উপসংহার
হাঁটু ব্যথা একটি সাধারণ কিন্তু উপেক্ষা করার মতো সমস্যা নয়। কারণ অবহেলার ফলে এটি দীর্ঘমেয়াদে পঙ্গু করে দিতে পারে। তাই সমস্যার মূল কারণ বুঝে যথাযথ চিকিৎসা ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের মাধ্যমে হাঁটু ব্যথা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। চিকিৎসকের পরামর্শ, সঠিক ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাসই হলো হাঁটু সুস্থ রাখার চাবিকাঠি।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url